কথায় বলে
“ক্যারিয়িং কোল টু নিউক্যাসল্” আমাদের দিশী ভাষায় “বরেলি মে বাঁশ লে যানা”। মানে
আসলে একই। নিউক্যাসলে কয়লার খনি আছে। সেখানে কয়লা নিয়ে যাওয়া বোকামো। বেরিলিতে
(বরেলি বলে হিন্দি তে) খুব ভালো বাঁশ পাওয়া যায় কিনা তা জানিনা। তবে প্রবচনটার
মানে একই। কোয়েম্বাত্তুর পৌঁছে হাতের মালপত্রের ভারের চোটে মনে হলো এই প্রবচনের
বাংলা হওয়া উচিত “কোয়েম্বাত্তুরে কাপড় নিয়ে যাওয়া”। শুনলাম গোটা ভারতের পোষাক
উৎপাদনের সিংহভাগ এই শহর থেকেই হয়। চতুর্দিকে কাপড়ের কল। উটি থেকে রওনা হয়ে
সন্ধ্যের ঝোঁকে এসে পৌঁছেছি ভারতের এই নতুন ম্যাঞ্চেস্টারে। ব্রিটিশরা আমাদের ছেড়ে
গেলেও আমরা এখনো কোন কিছুর তুলনা আনতে গেলে বিলেতি উদাহরনই খুঁজি। নয়ত, একসময়
দুনিয়া জোড়া খ্যাতি সম্পন্ন মসলিন কাপড় তৈরি হত
আমাদেরই বাংলায়। সে উদাহরন মনে আসেনা কেন?
কোয়েম্বাত্তুরে
কাপড় কিনতে আসিনি অবশ্য। এর আগে “দক্ষিনাবর্ত” তেই লিখেছি, চেন্নাইতে আমরা শাড়ি
কেনার কোটা পূর্ন করেই এসেছি। কোয়েম্বাত্তুরে ‘ক’ এর বড় মহিমা। কাপড়ের ক থেকে মুখ
ফিরিয়ে থাকলেও কলার ‘ক’ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারলাম না। ড্রাইভার
বাবাজি রাস্তার পাশে ক্যাঁচ করে গাড়ি দাঁড় করাতেই...সবুজ, হলুদ, লাল, রঙের নানা
আকারের কোয়েম্বাত্তুরের কলার কাঁদি, গাড়ির খোলা জানলা দিয়ে বর্শার ফলার মত ঢুকে
এসে আমাদের কোণঠাসা করে দিলো একেবারে। হলুদ রঙের চাঁপা কলা মার্কা একটা কাঁদি কিনে
তবে পরিত্রান পাই। এখানের কাঁচকলা ভাজার স্বাদ নিতে কিন্তু কেউ ভুলবেন না যেন ।
কোয়েম্বাত্তুরে পেরিয়ে তামিলনাড়ু আর কেরল এর সীমান্ত টপকে,
ওপারের পালঘাটের (মালায়লি তে পালাক্কাড়) দিকে রওনা দিতে হবে, কারন পালাক্কাড় জংশন
স্টেশন থেকেই রাতের ট্রেন এ আমাদের মালাবারের ট্যুর শুরু। কোয়েম্বাত্তুর
তামিলনাড়ুতে, সেখান থেকে পালাক্কাড় বড়জোর ঘণ্টা খানেকের রাস্তা। এর পরে পশ্চিমঘাট
পর্বত এ পালঘাট গিরিপথ, বলা হয় ‘পালঘাট গ্যাপ’ যার ওপারে উপকূলবর্তি কেরালা, এই গিরিপথ প্রকৃতির খেয়ালে
তৈরি আর তামিলনাড়ু হয়ে স্থলপথে কেরলে প্রবেশের সবচেয়ে সোজা রাস্তা।
পালঘাট শহর
এবং এই সমগ্র জেলা, কেরলের ভাতের জোগানদার। ‘রাইস বউল অফ কেরালা’ চোখ জুড়িয়ে দেয়। দূরে নীলচে
পাহাড়ের সারি আর সবুজ ধানের ক্ষেত যেন ঢেউ এর মত সেই পাহাড়ের দিকে চলেছে । খুব
আপন, খুব মন কেমন করা কিছু। আমরা চেনা ঘেরাটোপ এর একঘেয়েমি কাটাতে দূরে পাড়ি দিতে
চাই, অথচ অনেক দূরে গিয়েও বোধহয় আমাদের মন, চেনা জায়গার বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ খুঁজে
বেরায়।
শ্রীঅনন্তপুর । দক্ষিনে শ্রী হয়েছে থিরু, আর অনন্তপুর
হয়েছে অনন্তপুরম । নামটা বড় বটে, কিন্তু ভারি সুন্দর । ঠিক যেন প্রাচীন ভারতের কোন
জনপদের নাম । প্রাচীন সমৃদ্ধশালী
ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের রাজধানী এই থিরুবনন্তপুরম । সমগ্র ভারতের মধ্যে অন্যতম বিষ্ণু
মন্দির, শ্রী পদ্মনাভস্বামী মন্দির এর আশেপাশে এই শহর গড়ে ওঠে ত্রিবাঙ্কুর মহারাজ
দের পৃষ্ঠপোষকতায় । আজ ও এই অতি আধুনিকতার যুগেও এই রাজধানি শহরের প্রাণকেন্দ্র
কিন্তু কোনও আকাশচুম্বী টাওয়ার অথবা কোনও শপিং মল নয় । এই মন্দির কে ঘিরেই এবং এই
মন্দির থেকেই আজও এই শহরের ব্যাস্ততার, আধুনিকতার, সংস্কৃতির শুরু ।মন্দিরের ভিতর শ্রী বিষ্ণুর অনন্তশয়ানে শায়িত মূর্তি অথবা
মন্দিরের গায়ে অপূর্ব কাঠের কারুকার্য
দেখতে, যেমন অনেক দূর থেকে মানুষ ছুটে
আসে, তেমনি অন্ধ ভক্তের দল ভিড় করে, যারা কিছু না দেখে, না বুঝে, না জেনে, শুধু
বিশ্বাস করতে আসে, এতদিনের জীবনের ব্যাথার বোঝা নামাতে আসে, প্রতিকার চাইতে আসে ।
চাঁপা ফুল, ধুনোর আর অন্তরের গভীরতা থেকে উঠে আসা বিশ্বাসের গন্ধ যেন আমার এতদিনের
লালিত, মনের যুক্তিবাদি অংশকে এলোমেলো করে দেয় । আমারও এদের মত করে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে
।
থিরুবনন্তপুরম বড় ‘বিচিত্র’
শহর । এর চারিদিকে ‘বিচ’ । শহরের মধ্যিখানে শঙ্খমুঘম বীচ, (এই শঙ্খ মুখি বেলাভূমি
সূর্যাস্ত দেখার এক মোক্ষম জায়গা)। শহর
থেকে ১৭ কিমি. দূরে জগতবিখ্যাত কোভালম,
(এর খ্যাতির কি কুখ্যাতির পিছনে হিপি দের অনুদান প্রচুর) এখানে মধ্যবিত্ত ভারতীয়
সস্তায় ইউরোপীয় জীবনের স্বাদ পেতে আসে, আর সব শেষে ভারকালার পাপনাশম বীচ, (নাম
শুনেই বুঝতে পারছেন, মা মাসি সঙ্গে থাকলে,
আপনি এখানে যেতে বাধ্য)।
পৃথিবীর সব বীচ যে আদতে
একই, বালি আর লোনা জলের খেলা মাত্র, এই সোজা কথাটা যখন আমার মা কে বোঝাতে না পেরে
পাপনাশম বীচের দিকে বাধ্য হয়ে যাচ্ছি, ঠিক
তখন টেম্পো ট্রাভেলর এ, আমার পিতৃদেব আর আমার, দুজনেরই একটা চরম
সত্যের উপলব্ধি ঘটল । আরও একবার বুঝলাম যে, যা হয় তা ভালর জন্যেই হয় । আমার বাবা,
টেম্পো ট্রাভেলর এর চালক ভেনু র কাছে জানতে পারলেন যে তাঁকে অনেকটা রজনিকান্তের
আদলে দেখতে (অবশ্য এর পর থেকে আমার পিতৃদেব কে ঘরের মধ্যেও সানগ্লাস খোলাতে বেগ
পেতে হয়েছিল আমাদের) আর আমি জানলাম আপ্পাম সহযোগে মাটন স্ট্যূ এর স্বাদ । আপ্পাম
অর্থাৎ চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি রুটি, অনেকটা আমাদের সরু চাকলির
মত। এখন ও খুঁজে বেড়াই সেই আপ্পাম এর স্বাদ,
যেটা ভারকালা পাপনাশম বীচে যেতে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট খাবার দোকানে পেয়েছিলাম।
প্রত্যেক শহর এর কিছু
বৈশিষ্ট থাকে । তিরুবনন্তপুরম এর স্বকীয়তা বজাই রেখেছে সেই শহরের মানুষের মূল্যবোধ
। এই বিশ্বায়ন এর যুগেও তাদের কৃষ্টি ধরে রাখার আন্তরিক ইচ্ছে তাদের শহর কে আলাদা
করেছে ভারতের অন্য শহর গুলোর থেকে । বিশাল বিশাল হাল ফ্যাশনের সাদা বিদেশি গাড়ি
থেকে নামতে দেখেছি মালায়ালি দের, পরনে সাদা ধপধপে পাটভাঙা ধুতি, ওই লুঙ্গির মত করে
পরা, আর সাদা শার্ট । চেহারার আভিজাত্য কিন্তু জিন্স আর টি – শার্ট এর অভাব এ
একটুও কম লাগেনি । তাদের আচরনে সংযম, মুখে
হাসি । ঔদ্ধত্য চোখে পড়েনি কোথাও । অথচ দেশের এই রাজ্যটাই সব চেয়ে বেশি সংখ্যক
মানুষ কে দেশের বাইরে পাঠায় । খাঁড়ির দেশ গুলো তে ভারতীয় দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিক
হিসেবে এরা বিশেষ ভাবে সমাদৃত । এই জায়গা টা তারা আদায় করেছে কঠোর পরিশ্রম করে । এদের শিক্ষা আছে, খোলা মনে নতুন কিছু কে পরখ করার মানসিকতা
আছে, অথচ কই, তার জন্যে তো নিজস্বতা কে বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি এদের । বড় ভাল
লাগলো । মালয়ালিদের কাছে বোধহয় অনেক কিছু শেখার আছে আমাদের ।
এর পর আরো দক্ষিনে পাড়ি দিয়েছি
আমরা। আরো নতুন কিছু দেখা। তবে সে আর এক গল্প, আবার এক দিন হবেখন। আজ এই খানেই
দাঁড়ি টানলাম।
No comments:
Post a Comment